Tuesday 14 September 2021

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়--

অজানার মাঝে রহস্যময়তা লুকিয়ে থাকে। জন্ম-মৃত্যু বুঝি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়  রহস্য। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আমরা অভ্যস্ত, অভ্যাসগুলি আমাদেরকে নিয়ম চারিতার মাঝে বেঁধে রাখে। এর বাইরেও যে একটা জগত আছে তার সামান্য ধারণা আমরা মনের মাঝে পুষে রাখি। এছাড়া থাকে আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস। যা চোখে দেখতে পাই না তার অস্তিত্ব নেই, এমনটাও তো হতে পারে না। কোনদিন গ্রীনল্যান্ড না দেখলেও জায়গাটা যে আছে এ বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল আছি। ভূত বা অলৌকিকতার ওপর স্পষ্ট ধারণা সবার নেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির ধারণাকে নিয়ে আমরা প্রামাণ্য কিছু খুঁজে পাই না বটে তবু তা নেই. বলে কখনোই উড়িয়ে দিতে পারি না।

ভগবান বা দেবদেবীদের সাক্ষাৎ দর্শন না পেয়েও আমাদের মধ্যে আস্থা থেকে যায়। ঠিক তেমনি অশরীরী আত্মা আছে সে আত্মা অজর অমর এ হেন হাজারো ব্যাখ্যা আমরা আনদেখা করতে পারি কি? আমাদের এই পৃথিবী কত না রহস্যময়--দুরন্ত ঘূর্ণির মত পৃথিবী ঘুরছে কিন্তু আমাদের শারীরিক স্থিরতা একদম স্বাভাবিক। তবে এই স্থিরতা সময় সাপেক্ষ, সময় আমাদের ক্রমশ জীবনের শেষ প্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায়--যার পরিণতি হল মৃত্যু। মৃত্যুভয় থেকে বড় ভয় বুঝি আর কিছু নেই। মৃত্যু রহস্য সব চেয়ে বড় রহস্য--একে উজাগর করা যায় নি। মৃত্যু সত্য কিন্তু তারপর তার কোনো অস্তিত্বই কি আর অবশেষ থাকে না?

আত্মার অমরতা আমরা মেনে নিয়েছি, জন্ম-জন্মান্তরের বিশ্বাসও আমাদের মনের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আত্মার অস্তিত্ব যখন আমরা  মেনে নিতে পারি তখন তার নামান্তর ভুত-প্রেত শব্দগুলি শুধুমাত্র কাল্পনিক হবে কেন ? ভূত-পেত্নী ইত্যাদি শব্দগুলির সৃষ্টির মধ্যে কিছুটা উদ্ভট মানসিকতা থাকলেও আমরা সত্যকে লংঘন করতে পারে না।

ভগবানকে বিশ্বাস করতে পারলে ভুতের অস্তিত্বকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। ভগবানকে সেই জানে যে কিনা মনন সৃজনে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন আর ভূতকে সে জানে যে কিনা তেমনি এক পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন।

ভূতের সঙ্গে ভগবানের তুলনা হয় না জানি কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে অস্তিত্ব খুঁজে ফিরতে ফিরতে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি। হেড-এর বিপরীত দিক যেমন টেল হয় তেমনি ভগবানের অপর প্রান্ত আত্মা-প্রেতাত্মা মানে ভূত-পেত্নী--এ কথা ধরে নিতেই পারি।  

বাস্তবতার পাঁয়তারা কষলেও মনে মনে আমরা অলৌকিকতা দেখতে, শুনতে ভালবাসি। চমৎকারী দৃশ্যগুলি বুঝি আমাদের মনেও সৃজিত হয়, স্বপ্ন স্মৃতি নিয়ে রাতের জানা-অজানা টানাপোড়েনে আমরাও দোদুল্যমান হই। আমরা পক্ষীরাজে ঘুরে বেড়াই, কল্পবৃক্ষ ঝাঁকিয়ে কুড়িয়ে নেই বঞ্চিত মনের ইচ্ছেগুলি। 

যাই হোক, ভূত পেত্নীর অপশব্দের প্যাঁচে না পড়ে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে আসুন না আমরা তাদের রহস্য অলৌকিতার মাঝে খানিকটা ডুবে যাই।

আজ এ পর্যন্ত। ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন, করোনা ভূত থেকে সর্বদা বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা করবেন। জানবেন এ ভূত ঘাড়ে নিয়ে আমাদের সারাটা জীবন বেঁচে থাকতে হবে। নিবেদনইতি--তাপসকিরণ রায়, সম্পাদক, বর্ণালোক, দ্বিমাসিক অণুগল্পের ব্লগ ও ই-পত্রিকা।


সহঃ সম্পাদকের কলমে:

সময় চলিয়া যায় নদীর ও স্রোতে। তেমন ভাবে আমরাও এগিয়ে চলছি আমাদের সমস্ত ধারনা কে  সঙ্গে করে। দেখতে দেখতে আবার একটা শরৎ কাল  চলে এলো। আসতে আসতে শুরু হয়ে গেছে দেবীকে বরণ করে নেওয়ার সময়। আমরাও আমাদের পত্রিকাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি নতুন ধারায়। আরো ভালো কি ভাবে করা যায় চলছে তারই প্রস্তুতি একেরপর এক সংখ্যায়। বছর ঘুরে যেমন দেবী আসছেন তেমন ভাবে আপনারাও থাকুন আমাদের পাশে। লেখক লেখিকা থেকে শুরু করে পাঠক পাঠিকা পর্যন্ত। পাঠকরাই আমাদের সম্পদ। পত্রিকাটি আপনারা যত ভালোবাসবেন আমরা তত এগিয়ে যাবো।

--শমিত কর্মকার সহ-সম্পাদক, বর্ণালোক, দ্বিমাসিক অণুগল্পের ব্লগ ও ই-পত্রিকা

 

সহ-সম্পাদিকার কলমে--  

এবারের অণুগল্পের বিষয় হলো ভূত-ভৌতিক-অলৌকিক।

অজানা-অদেখা অতীন্দ্রিয়  জগতের গল্প। ভূত আছে কী নেই, এ নিয়ে যতই বিতর্ক থাক না কেন ভূত বা ভৌতিক জগত সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহলও কিছু কম নয়! আবার লৌকিক বিশ্বাসের বাইরেও যে কিছু শক্তি ক্রিয়া করে অর্থাৎ অলৌকিক ঘটনাবলী  সে সম্পর্কেও মানুষের আগ্রহের সীমা পরিসীমা নেই।

তবে ভূতের অস্তিত্বটুকুও যে ক্রমশ বিপন্ন হয়ে আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। না আছে আশ শ্যাওড়ার ঘন জঙ্গল না কোন পোড়ো বাড়ী। শ্যাওড়া গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা পেত্নীরাও একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখন ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। প্রমোটারের কল্যাণে এ সমস্ত আজ অবলুপ্তির পথে। যদিও বাঁশবাগানের বাঁশঝাড় গুলি এখনো সম্পূর্ণ রূপে তেনাদের  হাতছাড়া হয়নি। ভূত নিয়ে তর্ক বিতর্ক যারা করে করুক, ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে যাদের সন্দেহ থাকে থাক, ভূতের গল্পের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই হবে। দেশে বিদেশে সাহিত্য জগতের অনেকটা জুড়েই রয়েছে  ভৌতিক জগতের বিশাল সাম্রাজ্য।  

শুধু মাত্র শিশু কিশোর সাহিত্য বলে নয়, বড়দের অনেক পত্রিকাই ভূত বিষয়ক সংখ্যাও প্রকাশ করে থাকে।

এবারের অণুগল্প গুলির মধ্যে  ভূতেরাই না হয় বিচরণ করুক স্বচ্ছন্দে।

---সহ-সম্পাদিকা, বর্ণালোক, দ্বিমাসিক অণুগল্পের ব্লগ ও ই-পত্রিকা। 

জয়িতা ভট্টাচার্য--কালো বেড়ালটা


কালো বেড়ালটা

জয়িতা ভট্টাচার্য 


একটানা ঝিপঝিপ বৃষ্টি সেই বিকেল থেকে।কিছু মানুষ ছাতায় আর কিছু লোক বিনা ছাতায় ভিজে চুপচুপে হয়ে ফিরছে বাসায় ওই কাকেদের মত,যারা বসে আছে আমার জানলার সামনের তারে।

ঘরে আবছা অন্ধকারে মা শুয়ে আছে। আলো জ্বালিনি ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তিন চারদিন এভাবেই।এখন আর সময়  গুনি  না।খুব কাশছিল আর জ্বর।ঘুমিয়েছে শেষে। ঘরে চাল আছে, ডাল,ডিম শেষ।বিস্কুট বয়ামের তলার দিকে কিছু আছে এখনও।মা ঘুমোচ্ছে।দুধ খেয়ে। দুধ আর নেই।আমি চুপচাপ ভাবছি অনেক কথা।গলায় ব্যথা। কাশি।হোক গে। মনে পড়ছে কত কথা।

সেই ভাঙা টালির ঘর। চ্যাংরাবান্ধা থেকে কয়েক মাইল ভেতরের গ্রাম।আমার বাবা,ছেঁড়া লুঙ্গি, মায়ের তাপ্পি দেওয়া শাড়ি শুকোচ্ছে দড়িতে?তখন বড্ড অভাব। মন ছোটো।ফুটপাথে বসে বিক্রি করতাম হরেক মাল।আমি আর দাদা। পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হোলো।তখন  কলকাতা এক স্বপ্নের দেশ।দাদার ছিল অন্য স্বপ্ন, বাবারও।আমি চাইতাম টাকা।পথেঘাটে দামি জামা পরা সুন্দরী মেয়ে। আমার মা-ও সুন্দরী খুব। মা-ও সাচ্ছন্দ্য চেয়েছিল।

এখন বসে আছি নলিন সরকার স্ট্রিটে র শ্যাওলা ধরা প্রাচীন বাড়িটার দোতলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে।মাঝে তিস্তা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। 

ঝড়ে ভেঙে গেছিল টালির চাল।ভিজে একাকার।বাবা তখন বিছানায় পেচ্ছাব পায়খানা করে ফেলে মা সব পরিষ্কার করত।সেই ঝড়ের রাতে দেখেছিলাম ঘরের কোণে প্রথমবার বেড়ালটাকে।হ্যারিকেনের আলোয় আবছা আরো কালো অন্ধকারের স্তূপ যেন। নিঃশব্দে এসে বসেছিল সে। অথচ কেউ দেখতে পায়নি।মা ও দেখতে পায়নি কোনো বেড়াল।

সে রাতে বাবা চলে গেল।  

প্লাবন আর দাদার ফেরার হওয়া একই বছরে।

এসব ভাবতে ভাবতে পায়ের কাছে চলে এলো কালো বেড়ালটা।লাফিয়ে বসল উঠে মিটসেফের ওপর।ওর হলুদ চোখ জ্বলজ্বল করছে।একদৃষ্টে দেখছে মা কে।মা ঘুমিয়ে আছে।কদিন ধরেই আসছে ও।জাগাবো না এখন মা কে। দেখেছি এর পরেও ওকে একবার।

জ্বর আসছে আমার।শীত।

কী যেন ভাবছিলাম। 

ঘর জমি বেচে এই কলকাতায়

শেষে এই আমি আর মা।কলেজস্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান আমার।একজন ঢুকতে পারে এত ছোটো।তবু বই।অনেক বই পড়তে পারি।মাঝেমধ্যে দু একটা খদ্দের আসে।অতিমারীর লকডাউনের জন্য দোকান বন্ধ। অনেক বই জলে নষ্ট। আমার আর বিয়ে করা হয়নি।দাদাকে ওরা ধরে ফেলেছিল। কী সব স্বপ্ন দেখত। শুনেছি ওরা সরাসরি গুলি করেছিল বুকে। আমি দাদাকে এমন ঘুমোতে দেখেছি।ময়লা ছেঁড়া শার্টে কাদা আর রক্ত।সেবারেও দেখেছি বেড়ালটা ওই ঝোপের পেছনে দাদার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল।চোখ দুটো...অথচ মা ,বোন ওরা কেউ দেখতে পায়নি কোনো বেড়াল।কেউ না। রক্ত মাখা  বুকে মুখ ঠেকিয়ে রক্তের ঘ্রাণ নিচ্ছিল। সবজে দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছিল ওর চোখ থেকে।কী নিষ্ঠুর, কী নির্মম! এখন আর কিছু মনে হচ্ছে না।  

দুধ নেই।আমি জাগাইনি আর মা কে।আলো জ্বালি।মৃদু হলদেটে আলো।পাখাটা পুরোনো।ধীরে ধীরে ঘুরছে,ব্লেডগুলো কালচে মথের মত উড়ছে গোল হয়ে।

এবারেও এল।তখনই চিনেছি ওকে।সেই এক কালো বেড়াল জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ।

রাতে জ্বর বাড়ল। অনেক জ্বর। দম আটকে আসছে।মায়ের গা থেকে আধপচা গন্ধটাও আর পাচ্ছি না পাশে শুয়ে। দম আটকে আসছে আমার।উফ।একটু বাতাস চাই। হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কা, শেষবার দেখতে পেলাম মুখের ওপর ঝুঁকে আছে দুটো তীব্র হলুদ চোখ


বাড়ির সামনে ভর দুপুরে খুব ভিড়।কাগজের প্রথম পাতায় " মা ও ছেলের মৃতদেহ উদ্ধার।বৃদ্ধার দেহে পচন ধরেছিল।পড়শিরা খবর দেয় থানায়... "

 

Wednesday 8 September 2021

অর্পিতা ঘোষ পালিত--নগেনকাকার ভূত দর্শন




নগেনকাকার ভূত দর্শন

অর্পিতা ঘোষ পালিত


         নগেনকাকা খালের ধারের জমিতে কদিন হলো ধানের চারা লাগিয়েছে। এই খরার সময়ে জল-সেচ দিতে হয় প্রায়দিনই, নয়তো প্রখর রোদের তাতে ধানের চারাগুলো পুড়ে ছাই  হয়ে যাবে। যখনকার কথা বলছি তখন নগেন কাকাদের গ্রামের দিকে  রিভার-পাম্প বা ডিপ-টিউয়েল চালু হয়নি। ডি,ভি, সির খাল থেকে ডোঙা করে জল তুলে চাষের জমিতে দিতে হয়।  দুপুরের খর-রোদের জন্য নগেনকাকা  সন্ধ্যে নেমে এলে  চাঁদের আলোয়  জল দিতে যায়।

      সেদিন  নগেন কাকা সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে বেরোলো  জমিতে জল দেওয়ার জন্য। চাষী মানুষ ভয়-ডর কম,  ভয় শুধু  পোকামাকড়ের। অন্ধকারে আলের ধারে কোথায় শুয়ে থাকবে তাই দেখে পা ফেলতে হয়। চারিদিকে শুনশান, কেউ 

কোথাও নেই, ডোঙাটা নিয়ে খাল থেকে জল তুলে জমিতে জল দিচ্ছে নগেনকাকা।  কাকার খুব বিড়ির নেশা, মাঝে মাঝে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। 

       মাটিতে জল পড়া মাত্রই শুষে নিচ্ছে, পুরো জমি ভিজতে বেশ রাত ও হয়ে গেল। একটা বিড়ি ধরিয়ে আবার জল দিতে শুরু করলো। হটাৎ শুনলো পাশ থেকে কে যেন বললো  –  এঁকটা বিঁড়ি দেঁ, সেঁই থেঁকে এঁকের পঁর এঁক বিঁড়ি তোঁ এঁকাই টাঁনছিস। আঁমাকে এঁকটা বিঁড়ি দেঁ। নগেনকাকা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ কোথাও  নেই। নগেনকাকা গ্রামের ছেলে, তাই বুঝতে পারলো নাঁকি সুরে কে কথা বলছে, আজ কার পাল্লায় পরেছে। 

 নগেনকাকা – একটু দাঁড়া দিচ্ছি … এই বলে সেদিনকার মতো ডোঙাটা রেখে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা দিল … এবার ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়। আগের বিড়িটা শেষ হওয়ার আগে আর একটা বিড়ি ধরালো।  নগেন কাকা ছোট থেকে  শুনে আসছে, কাছে আগুন থাকলে নাকি ভূতে ছোঁয়না, একটু দূরে দূরে থাকে। আজ নগেনকাকা জমিতে আসার আগে এক বান্ডিল বিড়ি কিনেছে। একের পর এক  বিড়ি ধরাতে ধরাতে জমির আলপথ দিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। জমির সীমানা শেষ হলে তবে গ্রাম আসবে।

 ভূতটা সমানে নগেনকাকার পেছন পেছন আসছে আর বলছে – এঁকটা বিঁড়ি দেঁ, এঁকটা বিঁড়ি দেঁ। 

কিছুতেই পেছন ছাড়ছে না। নগেন কাকাও একটা বিড়ি শেষ হলে আর একটা বিড়ি ধরাচ্ছে আর  বলছে – দাঁড়া দিচ্ছি, দাঁড়া দিচ্ছি। 

        নগেনকাকা হাঁটতে হাঁটতে যখন গ্রামের সীমানায় ঢুকে পরলো, তখন ভূতটা বললো –  যাঁ যাঁ আঁজ খুঁব বেঁচে গেঁলি, তঁবে তোঁকে আঁমি ছাঁরবোনা। যেঁভাবেই হোঁক তোঁর ক্ষঁতি কঁরবোই।

       এরপর নগেন কাকা বাড়িতে গেল। আগুনে গা-হাত-পা সেঁকে ঘরে ঢুকলো।

      পরেরদিন সকালে নগেনকাকা ভাবলো... একটু ধানের জমির কাছ থেকে ঘুরে আসি, কাল তো ভূতের পাল্লায় পরে ছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখে  বিশাল ধানের জমি পুকুর হয়ে গেছে, একেবারে জমির আলের কানায় কানায় জলে টইটুম্বুর। মনে হয় ভূতটা সারারাত ধরে  নগেন কাকার জমিতে জল দিয়েছে।

        নগেনকাকা মাথায় হাত দিয়ে জমির আলে বসে পরলো। নিজে ভূতের হাত থেকে বাঁচলেও ধান গাছগুলোকে বাঁচাতে পারলোনা। 

       সেবার আর ধান হলোনা, খরার সময়েও সব ধানগাছ জলে পচে গেলো।


    ---------------------------------------;--------


Address :–

Arpita Ghosh Palit

Chourasta, Bidhubabu Lane,

P.O. -  Krishnanagar 

Dist -  Nadia

India

Pin - 741101

Mobile -  9733576950

         -------------


ঠিকানা:–

অর্পিতা ঘোষ পালিত

বিধুবাবু লেন,চৌরাস্তা,

পোস্ট- কৃষ্ণনগর

জেলা- নদীয়া

ভারত

পিন- ৭৪১১০১

মোবাইল-৯৭৩৩৫৭৬৯৫০

      ---------------------------------------------


লেখিকা পরিচিতি:--

অর্পিতা ঘোষ পালিতের জন্ম নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহর। ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ। তখন থেকেই চলছে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখালেখি। বিভিন্ন কাব্য গ্রন্থ, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, মাসিক পত্রিকা, শিশু সাহিত্য পত্রিকা ও দৈনিক খবরের কাগজে শতাধিক লেখা প্রকাশিত । বাংলাদেশের পত্রিকা ও দৈনিক কাগজেও বহু লেখা প্রকাশিত । 

 নিজের একক কাব্যগ্রন্থ " পাথর পাতা নদী" ও গল্পগ্রন্থ " জীবন কুড়ানো প্রহর" পাঠকের মাঝে  সমাদৃত।


    ----------------------------------------------


 আমার নিজের ভাবনায় রচিত অপ্রকাশিত লেখা। অন্য কোথাও থেকে অনুকরণ কিংবা অনুসরণ নয়।

 

Tuesday 7 September 2021

তৈমুর খান--ভ্রান্তির ভূত


ভ্রান্তির ভূত 

------------------------

তৈমুর খান

   

আলো জ্বলা দেখে বাড়ির কাছাকাছি যাচ্ছি আর অমনি মনে হচ্ছে বাড়িটা সরে গেল। আর একটু এগিয়ে গেলে বাড়িটার কাছে পৌঁছাব। এমনি করে করে যতদূর এগিয়ে যাচ্ছি বাড়িটা সরে যাচ্ছে। গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা দূর থেকে মনে হচ্ছে: হ্যাঁ আমাদেরই গ্রাম। রাস্তার দু'পাশে তালগাছ, গ্রাম ঢোকার মুখে বিশাল একটি বটগাছ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেমনই ধারণা। মানিকের সাইকেল ভালো করার সেই আটচালা। বামদিকে কুতুবের চায়ের দোকান। তেমনই তো সব ঠিকঠাক আছে!

     দাদু বললেন: সকালে তো এই রাস্তা দিয়েই  এসেছি! আমাদের ভুল হবার কথা নয়! কিন্তু এতটা পথ হেঁটেও এখনো পৌছালাম না কেন?

  আমিতো ভয়ে জড়োসড়ো। দাদুর বাম হাতের একটা আঙুল শক্ত করে ধরে আছি। রাস্তা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আকাশে ঘন ঘোর মেঘ। আষাঢ় মাস। ব্যাঙের সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকারা একটানা ডেকে যাচ্ছে। মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটা মালগাড়ি সো সো শব্দে পেরিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে দাদুকে বললাম: এবার আমরা ঠিক পথেই চলেছি আর ভুল হবে না।

   কিন্তু একটু পথে হেঁটেই বুঝতে পারলাম আমাদের পথটা ভুল। যে আলোটা নিকটেই মনে হচ্ছিল, এখনো সেটা তাই-ই মনে হচ্ছে। ওই যেমন বটগাছ, সাইকেল সারাইয়ের দোকান, চায়ের স্টল সবই মনে হচ্ছে আরও একটু দূরে। আমরা সেদিকেই লক্ষ্য রেখে হেঁটে চলেছি আর সেগুলিও ঠিক তেমন দূরত্বেই অবস্থান করছে।

 আর কতদূর যাব দাদু?

 আর একটু এগিয়ে যাই তারপর দেখি!

     কিন্তু আমাদের যাওয়া যে ফুরোচ্ছে না? সেই রাত দশটায় ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমেছি। বড়জোর আধঘন্টা লাগে আমাদের বাড়ি ফিরতে। ট্রেনটা লেট না করলে আমরা সাড়ে-আটটাতেই নেমে যেতাম। স্টেশন থেকে সোজা পশ্চিম দিকে মাত্র তিন কিমি রাস্তা হাঁটলেই আমাদের গ্রাম। আসার সময় পিসি বারবার বলেছিল আজ থেকে যেতে। আমারও তাই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দাদু থাকলেন না। জমিতে এখনো ধানের বীজ পড়েনি। কোন্ সময় বৃষ্টিতে সব ভর্তি হয়ে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে পরের দিন সকালেই মাঠে যাবেন। স্টেশনে নামার সময় কয়েকজন মাত্র প্যাসেঞ্জার তারা এদিক ওদিকে কোথায় চলে গেল। আমি আর দাদু পশ্চিম দিক বরাবর হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল আমাদের সামনে দিয়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো সেও আমাদের গ্রামে যাবে। তার সঙ্গ ধরার জন্য দাদু খুব জোরে হাঁটতে লাগলেন। আমি হাঁটতে না পেরে পেছনে পেছনে লাগালাম ছুট। কিন্তু লোকটাকে ধরতে পারলাম না। সে এগিয়েই গেল। তার পেছন পেছন হাঁটতে গিয়ে আমাদের এই দশা। আন্দাজ করছি তখন রাত বারোটা। কতবার আমরা একই রাস্তায় ঘুরে ফিরে বারবার একই জায়গায় পৌঁছচ্ছি। আর কেবলই মনে হচ্ছে আর একটু গেলেই আমাদের গ্রাম।

     অবশেষে আমরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমি বললাম: আর হাঁটতে পারব না দাদু! পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা! চলো আবার স্টেশনে ফিরে যাই। ওই ট্রেন গেল ওই পথ দিয়েই রেললাইনে হেঁটে স্টেশনে যাব। তারপর স্টেশনেই রাতটুকু কাটিয়ে দেব।

  দাদু রাজি হলেন। বললেন: স্টেশন মাস্টার দাসবাবু, আমার খুব পরিচিত। তাকে বলে একটা আলোর ব্যবস্থা করে নেবো।

  রেললাইন মুখি আমরা তখন প্রাণপণে হাঁটছি। কিন্তু কোন্ দিকে যাচ্ছি সেটা ঠিক করতে পারলাম না। কেবলই মনে হল সামনেই রেললাইন। কিন্তু অনেকটা হেঁটেও রেললাইনের নাগাল পেলাম না। কেবল একইভাবে মনে হতে লাগল: এইতো! আর একটু গেলেই পৌঁছে যাব!

     রাত তখন প্রায় দুটো। আবার আমরা হতাশ। কতদূরে স্টেশন? কতদূর রেললাইন? কে উত্তর দেবে? চারিপাশে চেয়ে দেখি শুধু অন্ধকার। সামনে শুধু আলো জ্বলছে। পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে সবদিকেই টিমটিমে আলো। তবে কেউ কি আলো জ্বালিয়ে এখন অপেক্ষা করছে? কাছাকাছি গেলেই মনে হচ্ছে আর একটু দূরে। এভাবে যে রাত কেটে যাচ্ছে। দাদু, কী হবে আমাদের?

     এবার এগিয়েই যাব। একটা গ্রাম তো পাব? যেখানে মানুষ বাস করে। মানুষ থাকলেই সাহায্য পাব।

     দাদুর কথা শুনে আমিও যেতে লাগলাম। দুই পা কাঁটায়-পাথরে ও মাটির ঢেলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছি না। কতক স্থান থেকে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে আঁধারে তা অনুভব করছি। কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছাব শুধু একটিই লক্ষ্য।

       যেতে যেতে হঠাৎ একটা বাড়ি চোখে পড়ল। ছোটখাটো একটা কক্ষ। খড় দিয়ে ছাউনি করা। একটামাত্র দরজা। দাদু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগলেন:

 কেউ আছো বাড়িতে? কেউ আছো? কেউ কি আছো?

 কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতরে অদ্ভুত একটা শব্দ হল। কান্নার শব্দ না হাসির শব্দ কিছুই বোঝা গেল না। দাদু আবার ডাকলেন: কেউ আছো সাড়া দাও! আমরা খুব বিপদে পড়েছি!

    হঠাৎ দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী এক অন্ধকার মানুষ। তার মুখের চেহারা কিছুই বোঝা গেল না। হাতদুটি এত দীর্ঘ যে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে আছে। শুধু চোখ দুটি আগুনের ভাটার মতো লাল। এ-কি কোনো মানুষের চোখ? হতেই পারে না। দাদুকে জড়িয়ে ধরেছি ভয়ে। দাদু স্থির হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন: গ্রামে যাব, রাস্তা ভুলে গেছি; আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দাও!

 অন্ধকার লোকটি এক অদ্ভুত হাসির শব্দ তুলে বললেন: কোঁন্ রাঁস্তায় যাঁবি? আঁমি দেঁখিয়ে দিঁচ্ছি আঁই!

        অগত্যা তার সঙ্গে-সঙ্গে যেতে হল। না গেলে যদি অন্য বিপদ হয়!

        সে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই তার মাটিতে পা পড়ে না। মনে হচ্ছে যেন বাতাসে ভর করে সে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আমরা তার সঙ্গে অত দ্রুত হাঁটতে পারছি না। তবু দাদু আর একটা কথাও বললেন না। ওর পরিচয়ও জানতে চাইলেন না। সেদিন কতদূর এগিয়ে গেলাম তার হিসাব করতে পারিনি। আমাদের সম্বিৎ ফিরল ভোরের আযান ধ্বনিত হওয়ার পর। তখন দেখি অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে। থেকে থেকে পাখিরা ডাকছে। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রহ্মাণী নদী। জলপ্রবাহের কুলুকুলু শব্দ কানে আসছে। স্টেশন থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরে এক মাঠের মধ্যে এক প্রাচীন এবং এক নবীন প্রজন্ম ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়েছি। সারারাতের এই পরিভ্রমণ স্বপ্নের মতো মনে হল। আলো আর অন্ধকার  এই দুইয়ের ভ্রান্তির শিকার আমরা।

 

কৌস্তুভ দে সরকার--সত্যি কি কেউ ছিল?


সত্যি কি কেউ ছিল?

কৌস্তুভ দে সরকার


"দ্যাখোতো, কে যেন মনে হল চলে গেল..."

আজকাল নমিতার এরকমই মনে হচ্ছে কেন যেন। সন্ধ্যায় দোতলার ঘরে বিছানায় বসে টিভি দেখে ওরা, বাবান পড়তে যায় তখন। অরূপ আর ও সেসময় চা খেয়ে, টিভি দেখে, একসাথে কিছুটা সময় কাটায়। সামনের দরজাটা খোলাই থাকে।  সামনের দরজায় সাদা পর্দা ঝুলতে থাকে। আর দরজার সামনেই সিঁড়ি। নমিতার মনে হয়, কে যেন এক ঝটকায় দরজার সামনে দিয়ে চলে গেল। উঠে যে গিয়ে দেখবে, তাতেও ভয় ওর । অরূপকেই বলে, "যাওনা, গিয়ে দেখে আসোনা একটু।" অরূপ বলে, "আরে ইঁদুর টিদুর হবে বোধহয়। তাছাড়া পাশের বাড়ির বেড়ালটাও আসে, ওটাই হবে হয়তো!" নমিতা জিদ ধরে বসে থাকে।  অগত্যা, অরূপ যায়। গিয়ে দেখে ঘুরে এসে বলে, "কই কিছু নাই তো। কেউ না। ওটা তোমার ভ্রম।" নমিতা কিছুটা আশ্বস্ত হয়। আবার মনে মনে কিছুটা ভয়ও পায়। বুঝতে পারেনা, এটা ওর নার্ভের দুর্বলতা নাকি অন্য কিছু। এত বড় বাড়ি ওদের, বড় বড় জানলা, কতরকম হাওয়া-বাতাস আসে, আসতেই পারে। ভেতরে অনেক গাছ, টবে, বারান্দায়। সেগুলোর ছায়াও প্রতিফলিত হতে পারে। তা সত্বেও কেন যেন ওর মনে হয়, ঘরে কেউ, কিছু একটা ঘোরাঘুরি করে। নমিতার কাছে পাড়ার কিছু মেয়ে সেলাই শিখতে আসে। ওরাও ওকে বলেছিল একদিন, "ম্যাম, আপনার বাড়িতে কি আর কেউ থাকে?" নমিতা বলে, "কেন বলতো?" ওরা বলে, "কেন যেন মাঝেমধ্যে মনে হয়, কে যেন চলে গেল দরজার সামনে দিয়ে।" ওরাও ভয় পায়। তবে কোনোদিন কোনোরকম ক্ষতি না হওয়ায় নমিতা মনকে কখনো আবার এই বলেও সান্ত্বনা দেয়, নিশ্চই কোনো ভাল আত্মা। হতে পারে তার শ্বশুরমশায়। এখানে উনার ছেলে, বৌমা আর নাতিকে পাহারা দিতে আসে। গোটা বাড়িটাই দেখে রাখে ওদের। হয়তো এটাই ঠিক। কেননা, সেদিন সামনের বাড়ির দাদা গল্পে গল্পে জানতে চেয়েছিলেন, "আচ্ছা, শ্রাবণী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় সারা বাড়িতে কি আপনারা প্রদীপের আলো দেখান?" "কেন বলেন তো?" নমিতা অবাকই হয়। আরে সেদিন সন্ধ্যায় তো ওরা তিনজনেই মলে গিয়েছিল, একটু এটা-সেটা কেনার জন্যে, আর একটু ঘুরে বেড়াতে - পূর্ণিমায়। সন্ধ্যায় তো  সেদিন ওরা ঘরে কেউই ছিল না। তাহলে বাতি দেখাচ্ছিল কে? সামনের বাড়ির দাদা বললেন, "আপনাদের জানলার কাঁচ দিয়ে আর সিঁড়িঘরের কাঁচ দিয়ে দেখলাম, মনে হল, বাতি নিয়ে কে যেন সারা বাড়িতে আলো দেখাচ্ছে!" নমিতা ঠিক বুঝতে পারে, ব্যাপারটা কি। 

বাড়ির ছাদে প্রচুর টব, নানারকম ফুল ও ফলের গাছ নমিতাদের। বাড়ির পোষ্যকে রোজ রাতে ডিনারের পর ছাদে ঘোরাতে নিয়ে যেতে হয়। এটাই রেওয়াজ। নমিতারও ভালো লাগে এটুকু সময়। তাছাড়া কথাতেই আছে, আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল। তবে, এরই মধ্যে সামনের বাড়ির কর্তা প্রয়াত হয়েছেন। পাড়ায় একটা শোকের আবহ চলছে। দুদিন হল, পোষ্যকে নিয়ে ছাদে উঠতেও ভয় পায় সে। শরীর ভারী হয়ে আসে নমিতার। কেন যেন মনে হয়, পেছনে কেউ ঘুরছে, ও ছাড়াও কেউ আছে ছাদে। নমিতার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। যত তাড়াতাড়ি পারে পোষ্যকে নিয়ে দৌড়ে নেমে আসে ছাদ থেকে। রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে বাথরুমে গেলেও এখন অরূপকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। কিন্তু এ যে আরেক নতুন আপদ মনে হচ্ছে ওর। শেষোব্দি অরূপকে বলে, "চলো না একটা কীর্তন দিই বাড়িতে। লোকনাথ বাবার।" অরূপ রাজি হয়ে যায়। জন্মাষ্টমীর দিন লোকনাথ মিশনের কীর্তন দল এসে পুজো-পাঠ করে , খোল-কর্তাল বাজিয়ে কীর্তন করে সারা বাড়ি মাত করে তোলে। পাড়ার সবার নেমন্তন্ন ছিল। প্রাসাদে ছিল ফ্রাইরাইস, মটর-পনির, ছোলার ডাল, আলুভাজা, চাটনি, রসগোল্লা। সবাই তৃপ্ত হয়ে খেয়ে বাড়ি যায়। সেই রাতের পর থেকে নমিতা আর কোনোদিনও ভয় পায়নি বাড়িতে, একা থাকলেও।

 

Monday 6 September 2021

শান্তা মিত্র--অবিশ্বাস্য


অবিশ্বাস্য 

শান্তা মিত্র 


এটি গল্প শোনালেও এটা একটা সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করেই লেখা। আমার এক খুব কাছের মানুষের  থেকে শোনা। তিনি একটি  শুটিং এ গেছিলেন। জায়গা টা ছিলো আলিপুরদুযার। ওখনেই একটা ভালো স্পটে শুটিং হয়েছিল । শুটিং শেষ করে ওখানে একটা নামী  হোটেলে ওরা উঠেছিল। (নামটি বলাটা হয়তো এখানে ঠিক হবে না)।  সারাদিন শুটিং এর ব্যস্ততা শেষ করে, রাতে  খাওয়া-দাওয়া করে সবাই  শুতে যায় যে যার ঘরে।   ওই ইউনিটেরই দুজন  মেকআপ আর্টিস্ট ( মহিলা) তারাও তাদের জন্য যে রুমটি বরাদ্দ ছিল সেখানে তারা শুতে যায়। শুতে যাওয়ার আগে তারা ঘরের সব কিছু বন্ধ করে বাথরুম বন্ধ করে শুতে যায়। তারা কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে,  তার কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ করে তারা শুনতে পায় বাথরুমের কল  থেকে জল পড়ছে। তাদের মধ্যে একজন উঠে গিয়ে কল টা বন্ধ করে আবার শুতে চলে আসে। তখন তাঁরা এ ওকে  দোষারোপ করে কল টা কেন বন্ধ করা হয়নি। তারপর আবার  চুপচাপ করে শুয়ে পরে,  আবারও কিছুক্ষণের মধ্যেই  সেই একই ভাবে কলের জল পড়ার আওয়াজ শুনতে পায় তারা, কারণটা বুঝতে না পেরে আবারও উঠে গিয়ে কল বন্ধ করে আসে এবং এসে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তারা আবারও একই শব্দ শুনতে পায়। এবার তো তাদের মনে ভয়ের সঞ্চার  হয়।  তারা আদৌও বুঝতে পারে না এটা অলৌকিক না ভৌতিক  বিষয়। এবার তারা তাদের ইউনিট কে বিষয় টি জানায় এবং তখন তাদের  ডিরেক্টর  অভিমুন্য বাবু এগিয়ে আসে ব্যাপারটা দেখতে।  তিনি এসে সব বুঝেসুঝে  ঠিক করলেন সেই রাতের জন্য তিনিই একাই থাকবেন ওই ঘরে।  আর ওই মহিলাদের অন্য এক রুমে সিফট্ করেন। যথারীতি  ডিরেক্টর অভিমন্যু বাবু সেই একই ব্যাপার এর সম্মুখীন হন।  তিনি খুব সাহসিকতার সাথে ব্যাপারটা  সামলে নেন।  এই খবরটা যখন সকালবেলা জানাজানি হয়  এবং হোটেল কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়ার পর তখন তাদের থেকে জানা যায় ওই রুমে কোনো এক সময় এক স্বামী-স্ত্রী 

এসেছিলন তারা দুজনেই একসাথে  সুইসাইড করেছিলেন, তাই তাদের আত্মাটা ওখানে ঘুরে বেড়ায়।  এই ঘটনাটা তাদের থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। পরের দিন সকালেও সবার চোখে মুখে সেই ভয়ের একটা আতঙ্ক কাজ করছিল। তাই তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই হোটেল পরিত্যাগ করে। ঘটনা টি শোনার আমারও  অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু এটা সত্যি ঘটনা।

 

মহুয়া বিশ্বাস--ভুতুড়ে কাণ্ড


ভুতুড়ে কাণ্ড

মহুয়া বিশ্বাস



একদিন বিকেলে  একটা বনের ভীতর দিয়ে বিশাল এক মাঠ-জঙ্গল পেরিয়ে দুই বন্ধু অসীম আর সুরেশ  মেলায় বেরিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে  হাঁটতে হাঁটতে  মাঠের মাঝ বরাবর  বেশ একটু রাত হয়ে এলো। চারপাশ নিস্তব্ধ, গাঢ় কালো সূচাভেদ‍্য অন্ধকার ! পাশেই একটা নদী বয়ে যাচ্ছে নিরবে। জনমানসের কোনো সাড়াশব্দ নেই ! শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক নিস্তব্ধ পরিবেশকে আরও  রহস‍্যময় করে তুলেছে! অসীমের হাতে একটা টর্চ। 

পথের ধারে বেশ খানিকটা বিস্তৃত জোড়া বাঁশ বাগান। গাছের মাথাগুলি ঝুঁকে পড়েছে একেবারে পথের উপর। দিনের বেলায় অন্ধকার নেমে আসে সেখানে। ঐ বিশাল বাঁশবাগানে পাশের গাঁয়ের বাঞ্ছাখুড়ো গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যা করেছিল।

ছোটো থেকে অসীম ও সুরেশ ঐ পথে যেতে গেলে ওদের বুক ধড়ফড় করতো। ঐ স্থানে নিঃস্বাস বন্ধ করে ওরা দৌড়াত। ওটা ওদের স্কুলে যাবার পথ ছিল। ভয়ে যেন হৃৎপিণ্ডের ধক্ ধক্ বন্ধ হবার উপক্রম হত। এক দিনের কথা মনে পড়ে অসীমের, দলবেঁধে  সব বাচ্চারা স্কুলে  যাচ্ছিল--ঐ গ্রামের  দুজন  রাখাল ছাগল  চড়াচ্ছিল। বাঁশবাগানের ভীতর। ঘাস, লতাপাতায়  আটকানো  ছিল বাঁশগাছের মধ‍্যভাগ পর্যন্ত। বাঁশগাছের সরু সরু শুকিয়ে থাকা শুকনো ডাল ভাঙবে বলে এক রাখাল বালক একটা বাঁশগাছে উঠতে লাগলো। গাছটি ছিল লতাপাতায় ঢাকা আর পাতাগুলো বেশ ঝুঁকে পড়েছে নীচের দিকে.....উপরের দিকে তাকানোর অবকাশ ছেলেটার ছিল না। আনমনে শুকনো ডাল ভাঙতে ভাঙতে গাছের আরও উপরে সে উঠে গেল। হঠাৎ তার মাথার ওপরের বারবার ঝুলন্ত ডালের মত একটা বাঁধাপ্রাপ্ত ডালকে ভেঙে ফেলার  জন‍্য  উপরের দিকে তাকাতেই তার সারা শরীর শিউরে উঠলো ! একটা মানুষের পা ঝুলছে তার ঠিক মাথার উপর !  সে চিৎকার করে বলল--'বাবা গো--বাঁচাও গো'---! ভূত ! ভূত ! ভুত ! সারা শরীর   তার ভয়ে অসাড় হয়ে এলো! সে গাছ থেকে নামবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। সে এতো মোটা ছিল যে বিক্ষিপ্ত বাঁশের ডালের ফাঁক  থেকে শরীরকে বের করে আনতে পারছিল না। তার ভুঁড়ি  ছোটো ছোটো কুঞ্চিতে বেঁধে গেল। এই দেখে ভয়ে তার  রাখাল সাথী  ঊর্ধশ্বাসে পলায়ণ করলো গ্রামের দিকে। ভয়ঙ্কর পরিবেশে নিজেকে বাঁচাতে ব‍্যাস্ত  অসহায় বালকটি  কাঁদতে কাঁদতে বলল--'ওরে আমাকে ছেড়ে যাস নে..আমার ভুঁড়ি বেঁধে গেছে..আমাকে বাঁচা..এখান  থেকে উদ্ধার কর !' 

স্বার্থপরের মত নিচের রাখাল বালক পলায়ণ করলো। গ্রামে পৌঁছে সে লোকজনকে জানালে..তারা সে স্থানে এসে হাজির হল--এবং এই ভাবে ঐ অসহায় রাখাল  নিস্তেজ শরীরে প্রাণ ফিরে পেল। 

আজ নির্জন অন্ধকার রাতে ঐ স্থানে এসে শৈশবের সে সব কথা মনে পড়তেই  অসীমের গা ছম্ ছম্ করে উঠলো। মনে করতে করতেই সে দেখলো, হঠাৎই সুরেশের সামনে একটা লম্বা বাঁশ কট্ কট্ আওয়াজে রাস্তার উপর আড়াআড়ি ভাবে নুইয়ে পড়লো। চমকে উঠলো দুই বন্ধু।

সুরেশ সামনে ছিল। চারপাশ ঘন জঙ্গল--কোনো রাস্তা নেই ! পথ একটাই। সুরেশ সিদ্ধান্ত নিল বাঁশটির উপর দিয়ে ডিঙিয়ে যাবে বলে। অসীমের ভরসা হচ্ছিল না..মনটা খট্ খট্ করছিল।

অসীম বলল--না..ঠিক হবে না! সুরেশ উত্তরে বলে উঠলো..তবে কি  এই বাঁশের অপেক্ষায় সারারাত  এখানে কাটিয়ে দেবো? কীংকর্তব‍্যবিমূঢ় অসীম স্তম্ভীত এই দৃশ‍্যে !  সুরেশ বাঁশটাকে টপকানোর জন‍্য এক পা ওপাশে দিতেই..সড়াৎ করে এক ঝটকায় নুইয়ে  থাকা বাঁশটি সচল হয়ে সুরেশকে তুলে নিয়ে উপড়ে উঠে গেল। অসীম থমকে বসে পড়লো। সুরেশকে ঐ বাঁশটি উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ধড়াস করে ফেলেদিল মাটিতে ! সুরেশ অজ্ঞান হয়ে গেল ! অসহায় একলা...প্রাণে একদম জোর ছিল না অসীমের। সমস্ত শক্তি যেন নিংড়ে নিয়েছে এই রহস‍্যময় পরিস্থিতি ! অবশ শরীর আর ভয়ে অসাড় মন নিয়ে কোনো রকমে অচৈতন‍্য সুরেশকে নিয়ে টানতে টানতে  বাঁশবাগান পেরোলো সে। ঠাকুরের নাম করতে করতে....আবার একটা বিপদ  এসে হাজির না হয় এই আশঙ্কায় সে এগিয়ে গেলো ! গ্রামের নিকটবর্তী মাঠে এসে  উপস্থিত হল। হঠাৎ অসীম দেখতে পেলো  একটা আলো জ্বলছে  টিম টিম করে.. আলোটিকে লক্ষ‍্য করে  অসীম এগিয়ে গেল। দুটো মানুষের কথপোকথনের  মৃদু শব্দ শুনতে পেল সে ! গলার স্বর বসে গেছে.. চিৎকার করার ক্ষমতা হারিয়েছে সে। তারা একটা ছাউনীর নীচে বসেছিল..লোকদুটো  মেশিনের মাধ‍্যমে  সেচের জল দিচ্ছে জমিতে। সেখানে পৌঁছিয়ে ধরে প্রাণ এলো অসীমের। তারা কিছু জিজ্ঞাসার আগেই অচৈতন‍্য সুরেশকে দেখে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়লো। মেশিনের জলের ছিঁটা  সুরেশের চোখে মুখে দিতেই  তার জ্ঞান ফিরে এলো। একটু সুস্থ  হলে ঐ ব‍্যাক্তিদের সাথে ওরা গ্রামে ফিরে গেল।

------------


সন্ধ্যা রায়--দেবদর্শন



দেবদর্শন 

সন্ধ্যা রায় 


সেদিন ছিল লক্ষীপূজ। মা সকালের পূজা সারছে। রাতে আবার ভোগ নিবেদন করে পূজ হবে। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন সাদা থান পড়নে এক বৃদ্ধা। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে বললাম - ঠাকুমা ভিতরে আস। উনি আমার সাথে এলেন। আমাদের একটা কাঠের চেয়ার ছিল তাতে বসতে দিলাম। বললাম, ঠাকুমা তুমি বস মা পূজ করে আসছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম নিজের ঠাকুমাকে কোন দিন দেখিনি ওনাকে দেখে আমার ঠাকুমা বলেই মনে হল। আমরা সবাই চুপচাপ। মা আসতেই ঠাকুমা বললেন, বৌমা আমাকে একটা কলাপাতা দাও। মা পূজার জন্য কলাপাতা যা তোলা ছিল তার ভিতর ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা সব গুছিয়ে দিল। ঠাকুমা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে  বললেন - তোমার আলপনা খুব ভালো হয়েছে। 

মা বলল, মাসিমা রাতে আমি পূজ করব রাতে আসুন। ঠাকুমা আসবে বলে চলে গেলেন। 

ঠাকুমা প্রায়ই আসতেন। চা খেতেন আর আমাদের গল্প শোনাতেন। ওনার দেশের বাড়ির, দেশের মন্দির, ভুতের, গাছপালা, ক্ষেতখামার, নদী পাহাড় এমনকি মুসলমানদের অত্যাচার, সব বলতেন। ঠাকুমাদের অনেক জমি জায়গা ছিল। ঠাকুর দাদু সব ঘোড়ায় চড়ে দেখা শোনা করতেন। 

আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। উনি এক আশ্চর্য গল্প শোনালেন। আমরা সবাই চুপচাপ বসে। উনি বলে চলেছেন-- 

সকালে বাসি কাজ সেরে পাশেই একটা মন্দির, ওখানে গিয়ে তিনি প্রণাম করে আসতেন। মন খারাপ হলে একটু বেশি সময় বসতেন। নামজপ ও করতেন।

মন্দির থেকে একটু দূরে একটা শিশু গাছের নীচে বেদীতে তিনি বসতেন। রোজের মত একটা ছেলে ফুলের ঝুড়ি দিয়ে যায়। হারাধন ঠাকুর দালান ঝাড়ু পোছা দেয়। তেঁতুল আর ঘাস দিয়ে বাসন মেজে চকচকে করে। ঠাকুমা এসব রোজ দেখেন। 

পূজ এসে গেছে। সকালে আজ মহালয়া হয়েছে। চণ্ডী পাঠের পর সবাই চলে গেছে। কাছে পিঠে আজ আর কেউ নেই। 

আজ ঠাকুমা একা একা দূরে শিশু গাছের নীচে বেদীতে বসলেন। নাম করতে করতে সূর্য উঠে গেছে। ঠাকুমা মন্দিরে প্রণাম করতে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় দাঁড়াতে দেখলেন, মা স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে !

স্বয়ং মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠাকমা মূর্ছা গেলেন। কতক্ষণ শুয়ে ছিলেন জানেন না। যখন জ্ঞান এল তখন শুনতে পাচ্ছেন মন্দিরের ঠাকুর মশাই জোরে জোরে ঘন্টা পিটিয়ে হাতে প্রদীপ নিয়ে আরতি করছেন। সেই শব্দে ঠাকুমা দূর্বল শরীরে উঠে বসলেন। উঠে কাঁদতে লাগলেন। 

ঠাকুর মশাই বললেন, মাসিমা কি হয়েছে ? আপনাকে কত ডাকলাম আপনি ওঠেননি, তাই আমি পূজটা সেরে নিলাম। 

ঠাকুমা কথার কোন উত্তর দিলেন না। উনি জানতেন - এসব আজ আর কেউ বিশ্বাস করবে না। উনি ধীরে ধীরে ঘরে গেলেন। ওখানেও সবাই বলল আজ এতো দেরি হল কেন ? তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, না হলে পেটে পিত্ত পড়বে। ঠাকুমা এ সবের কোন জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। ওনার ভগবান দর্শন ওনার মনেই রয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কাউকে উনি সেই অলৌকিক ঘটনার কথা বলেননি।

সমাপ্ত

 

শিখা মালিক--"ওখানে কে নাচে"



"ওখানে কে নাচে"                   

শিখা মালিক 


রাত ঠিক বারোটা ঝুম ঝুম ঝুম ঘুঙুরের আওয়াজ ,এত রাতে ঘুঙুর পায়ে কে যায়--।শুভ্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছে ,মামারা বনেদি ফ্যামিলি ,ব্রিটিশ আমলে নামকরা জমিদার সূর্যনারায়ণ  চৌধুরী  ছিলেন এদের পূর্ব পুরুষ ।এখন জমিদারি নেই কিন্তু ঠাকুর দালান বৈঠকখানা সিংহদুয়ার খিড়কি পুকুরের গুপ্ত সুড়ঙ্গ সব আছে ।শুভ্রর বড় উৎসাহ এই সুড়ঙ্গ নিয়ে ,দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায়  এখনকার  বড়রা সেদিকে যেতে নিষেধ করেছে ।কাজের লোক মিলিয়ে মোট দশজন লোক থাকে এখানে ,চার মামা থাকে শহরে ।মেজোমামা এখনকার জমিজায়গা দেখা শোনা করে তার দুই ছেলেমেয়ে শহরে পড়াশোনা করে কাজের লোক নরেন কাকা গোটা বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে ।নরেন কাকা রাত এগারোটায় কিছু  লাইট নিভিয়ে দেয় ,জ্বলছে ঠাকুর দালানের আলোটা  ঘুম না আসাতে শুভ্র বারান্দায় পায়চারি করছিল হঠাৎ ঘুঙুরের শব্দ কে যেন চলে গেল মনে হোল।ও তাই খুঁজতে  খুঁজতে  দেখে আওয়াজ টা বাড়ির গেটের বাইরে চলে গেছে ,গেট বন্ধ তাই শুভ্র গাছ বেয়ে পাঁচিল টপকায়  দেখে একটা সাদা ঘাগরা পরা মেয়ে চলে যাচ্ছে   জোছনা ঢালা রাত পরিস্কার  সে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটাকে মোহগ্রস্ত হয়ে সে চলে তার পিছু পিছু একটু পাশে মামাদের বড় বাগান আওয়াজ টা বাগানের দিকে যায় আবারও  গাছ বেয়ে বাগানে ঢোকে তখন মনে ভাবে মেয়েটা কি করে ঢুকলো! তাকে খুঁজতে থাকে শুভ্র ।হঠাৎ দেখে বাগানে বড় পুস্করিনীর মাঝে জলের উপর নাচছে মেয়েটা ,মাথাটা ঘুরে যায় তারপর যখন চোখ মেলে দেখে বিছানার পাশে মামা ডাক্তার বাবু নরেন কাকা ।নরেন কাকা বলে অত রাতে বাগান বাড়িতে কি করে গেলে দাদাবাবু,শুভ্র কিছু বলে না মাথায় ঘুরছে কে ও দুপুরে নরেন কাকাকে ফাঁকা পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে মেয়েটা জলের উপর নাচছিল কি করে?কে ও? নরেন কাকা বলে ঠিক জানিনে তবে শোনা কথা পূর্ব পুরুষরা তো জমিদার ছিল তারা নর্তকী  আনতো বাগান বাড়িতে ,এক নর্তকী জলে ডুবে মারা যায় ,অনেকেই মাঝে মাঝে দেখে তবে তুমি আর রাতে অমন করে যেওনা ,মামা বিকালে বলে শুভ্র দিদি ফোন করেছিল কাল বাড়ি যেতে বলেছে।

 

ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়--লকডাউন



লকডাউন

ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়  


কারখানায় কাজ করে দুখি।ছিদাম সামন্ত রায় বাবুদের কারখানাতে কাজ করতো।ব্যাগ তৈরির কারখানা।যেদিন টিবি রোগে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে গেল সেদিন ই দুখির জন্ম।রায়বাবুদের ওই কাজ এখন দুখি করে ।মাসে আটশ টাকা পায়।শুধু তাই নয়।বাড়ির যত ফাই ফরমাস সব দুখি করে দেয়।বিনিময়ে কলাটা মূলোটা কপালে জুটে যায় মাঝে মাঝে।

রন্ধ্রগত শনি দুখির জীবনের সঙ্গী।সবাই মিলে নাম দিলে দুখিরাম।যেন সব দায় ওর।অবশ্য নামে কী বা এসে যায়।দুখির বিয়ে হল লক্ষ্মীর সাথে।বারোমেসে রুগী।আসলে কপাল মূলোতোলা।


দুখির গানের গলা দারুন।বিয়েতে লক্ষ্মীর বাপ ওকে সাইকেল, টর্চ আর একখানা রেডিও দিয়েছিল।লক্ষ্মীর ওষুধ আর পথ্য জোগাড় করতে না পারায় সাইকেল আর টর্চ বিক্রি হয়ে গেছে।তবু দুখি রেডিও টা হাতছাড়া করে নি।ওর শখের জিনিস ওটা।


গ্ৰামের প্রান্তে যে পুকুর টা আছে ওর নাম বড়ো সরকার।ওর পাড়েই দুখির কুঁড়ে।সন্ধ্যা নামলেই লক্ষ্মীর সোই সোই ডাক শুনতে শুনতে হাঁসগুলোর সাথে দুখি ও ঘরে ফেরে।

দুখি এইসময় খোশমেজাজে থাকে।চা মুড়ি খায়।আর রেডিও টা জোরে চালিয়ে দেয়।দুখি গলা মিলিয়ে গাইতে থাকে "ও জীবন জীবন রে

ছাইড়া না যাও মোরে

তুই জীবন ছাইড়া গেলে

মাইনসে কৈবে মরা  জীবন রে"।


সন্ধ্যা গাঢ় হলে খবর শোনে দুখি।পৃথিবীতে কী ভাইরাস এসেছে।কত মানুষ মরে যাচ্ছে।কারখানা তে এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে।অশনিসংকেত।রোগে মরবার আগে না খেয়ে মরতে হবে দুখিদের।

পরের দিন কারখানা গিয়ে ওটাই সত্যি হল।লকডাউন।রায়বাবুদের অত টাকা নেই যে বসিয়ে বেতন দেবে।

দিন দশেক কাটলো।আর হাঁড়ি চরে না।বেদনায় ভরা লক্ষ্মীর মুখ কাতর করে দুখিকে।

একটু পরেই দুখি ফিরলো।বেশ কিছু স ওদা করে এনেছে।তেল ,মশলা,একটু মাছ।রায়বাবুর নাতি জোরে রেডিও চালিয়ে দিয়েছে।দুখি গেয়ে ওঠে

"তুই জীবন ছাইড়া গেলে

মাইনসে কৈবে মরা জীবন রে"।

 

শমিত কর্মকার--এ কেমন সব ভূতুড়ে কান্ড




এ কেমন সব ভূতুড়ে কান্ড

শমিত কর্মকার


সেই রাতটা যেন আজও বিভীষিকা ময়। এখনো যেন আতঙ্কের রাতটা মন থেকে মুছে ফেলা যাচ্ছে না। নবনীতা  আর রমেন নতুন বিয়ের পর বেড়াতে গিয়ে ছিল। নবনীতা র পুরাতন বাড়ি বনজঙ্গল দেখতে ভালো লাগে বলে কাছাকাছি মুর্শিদাবাদ নিয়ে গিয়েছিল রমেন। অতিমারি থাকায় বেশি দূরে যায় নি। নবনীতার শোনবার পর থেকে বেশ ভালোই লেগেছিল। শিয়ালদহ ষ্টেশন থেকে লালগোলা ফাষ্ট প্যাসেনজারে সীট বুক করে নিয়েছিল রমেন। দুজনার ট্রেনে উঠে সীটে বসে বেশ মজাই লাগছিল যে আজ তারা কলকাতা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে। যাত্রা পথের নানা অভিজ্ঞতা নবনীতার বেশ লাগছিল। 

        দুপুর দুটোর সময় রমেন আর নবনীতা মুর্শিদাবাদ ষ্টেশনে এসে নামল। রমেন ষ্টেশনে নেমে একটা দোকানে ঢুকলো খাওয়ার জন্য। জিনিস পত্র একটা জায়গায় রেখে ওরা দুজন খেতে বসলো। রমেন খেতে খেতেই দোকানে জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা দাদা এখানে থাকবার জায়গা কোথায় ভালো পাওয়া যাবে?দোকানের এক কারিগর বলল, দাদা ওই একটু দূরে ছাতিম তলায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন ভালো ভালো থাকবার জায়গার খোঁজ পেয়ে যাবেন। রমেন খাওয়া দাওয়া সেরে জিনিস পত্র নিয়ে নবনীতা কে সঙ্গে করে একটা রিক্সায় উঠল।

     ছাতিম তলায় এসে একটা ভালো বাড়ির সন্ধান পেয়ে সেখানেই উঠেছে নবনীতা ও রমেন। বাড়িটা দেখে দুজনের বেশ ভালো লাগলো। গাছগাছালি ঘেরা আলাদা একটা বাড়ি। ঐ বাড়ি থেকে আর সব থাকার জায়গা একটু দূরে। রমেন রাত্রের খাওয়া সেরে নবনীতা কে নিয়ে বাড়ি টায় এসে উঠলো। বাড়িটিতে রাত্রে যে পাহারা দেয় সে এসে বলে গেল আপনারা দুজনে রাত্রে একসাথেই থাকবেন, বাইরে বের হবেন না। বাড়িতে রাত্রের আলোও একটু কম ছিল। পাহারাদার চলে যাওয়ার পর ওরা ফ্রেশ হয়ে বিছনায় এসে বসলো। কিছুক্ষণ বাদে রমেন বাইরের বারানন্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।নবনীতা তখন ঘরে একা। নতুন জায়গায় এমন একটা ঘরে একা থাকতে তার ভয় ভয় করছিল। কিছুক্ষণ পর ঘরের একটা কোনে নবনীতা তাকাতেই দেখল টেবিলের উপর রাখা ফুলদানি টা কিছুটা সরে গেল, আরও ভয় তাকে পেয়ে বসল। আবার কিছুক্ষণ পর ঐ দিকে তাকালো দেখলো  ফুলদানিটা জায়গা পরিবর্তন করেছে, এবার নবনীতা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো। রমেন চিৎকার শুনে ছুটে ঘরের মধ্যে এলো, দেখল নবনীতা বড় বড় চোখ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রমেন নবনীতার পাশে বসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে কাঁদতে লাগলো। রমেন বলল তোমার কি হয়েছে? এমন করছো কেন? কোন উত্তরই সে দিচ্ছে না! কিছুক্ষণ বাদে বলল, তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলো। রমেন বলল, কেন?  এতো রাত্রে কোথায় যাবো। কিন্তু কেন এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছো? কি এমন হলো এইটুকু সময়ের মধ্যে, অনেক কিছু যা নিজের চক্ষে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু কি হয়েছে? বলছি, তুমি যখন বাইরে গেলে আমি তখন একা ঘরে বড় ঐ ঘরের এক কোনের দিকে দিকে হাত দেখিয়ে বলল ঐদেখো টেবিলের যে ফুলদানি টা আছে ওটা আপনা আপনি জায়গা পরিবর্তন করছিল। রমেন, কি বলছো তুমি! হ্যাঁ, আমি স্পষ্ট দেখেছি। এবার রমেন বলল, চলো আমরা শুয়ে পড়ি কাল সকালে দেখা যাবে। এবার ওরা ঘরের  লাইটটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর রমেনের কানে এলো কে যেন ঐ বারান্দা দিয়ে হাঁটছে, সে ভাবলো আমি তো কিছুক্ষণ আগেই ঐ বারান্দায় সিগারেট খেয়ে এলাম। রমেনের নিজের এবার কেমন যেন মনে হলো, তাহলে কি নবনীতা যা বলছে ঠিক! তার ও কেমন যেন লাগছে। তাহলে কি এই বাড়িটি.. সেই জন্যই কি পাহারাদার বাইরে বেরোতে বারণ করলো। রমেনের সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি এই বাড়ি টায় অন্য কিছু আছে? এই বাড়িতে কি অন্য কিছুর বাস! কিছুতেই ঘুম আসছে না, নবনীতা তাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল। গায়ে হাত দিয়ে দেখলো তার শরীর সম্পূর্ণ ঠান্ডা। 

     রাত শেষ হতেই পড়িমরি  করে ওরা দুজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর রমেন ঠিক করলো আর নয়, আজই তারা কলকাতায় চলে যাবে। নবনীতা তাকে বলল, এই রাতের কথা সারা জীবন মনে থাকবে। আমার অনেক বেড়ানো হয়েছে। 

            *********

 

সম্পাদকীয়--

সম্পাদকীয়-- অজানার মাঝে রহস্যময়তা লুকিয়ে থাকে। জন্ম-মৃত্যু বুঝি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়  রহস্য। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আমরা অভ্যস্ত, অভ...